মঙ্গলবার   ২১ মে ২০২৪ || ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ১৩:০৫, ৮ ডিসেম্বর ২০২৩

আপডেট: ১৩:০৭, ৮ ডিসেম্বর ২০২৩

করতেন ভিক্ষা, এখন ভ্যান চালান প্রতিবন্ধী কালু

করতেন ভিক্ষা, এখন ভ্যান চালান প্রতিবন্ধী কালু
ছবি : সংগৃহীত

নাম কালু বিশ্বাস, অভাবের সংসারে জন্ম তার। স্বাভাবিক শিশুদের মতো জন্ম নিলেও মাত্র ৪ বছর বয়সেই দুই পায়ে শক্তি হারাতে থাকেন। শুকিয়ে যেতে থাকে দুই পা। অন্য শিশুদের দুরন্তপনা দৌড়াদৌড়ি দেখে তার মনেও অনেক স্বপ্ন ছিল। কত ডাক্তার, কবিরাজ দিয়ে চিকিৎসা করেও কোনো উন্নতি হয়নি। সবশেষ কোনো উপায় না পেয়ে তাকে নিয়ে ভারতে যান তার পরিবার। সেখানকার চিকিৎসক তাকে পোলিও রোগে আক্রান্ত হওয়ার কথা জানায়। ভারতের চিকিৎসক জানান, কোনো প্রতিষেধকই তাকে আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে পারবে না।

সেই থেকেই তার শরীরে আকৃতি পরিবর্তন হয়ে ৪৫ বছরে তার শরীর ও হাত স্বাভাবিক মানুষের মতো হলেও উচ্চতা মাত্র ৩০ ইঞ্চি। অভাবের সংসারে বাবার বোঝা হয়ে যায়। উপায় না পেয়ে ১৬ বছর বয়স থেকে ঝিনাইদহ আদালত পাড়ায় ভিক্ষাবৃত্তি করতে বাধ্য হন। দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে ভিক্ষা করেন কিন্তু ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি, পাননি মানসিক শান্তি। এরপর ভিক্ষাবৃত্তি ছেড়ে ২০২২ সালে ভাড়ায়চালিত একটি ভ্যান নিয়ে জীবন যুদ্ধে নামেন তিনি। বলছিলাম ঝিনাইদহ সদর উপজেলার জাড়গ্রামের শুকুর বিশ্বাসের ছেলে পোলিও রোগে আক্রান্ত কালু বিশ্বাসের কথা।

সরোজমিনে গিয়ে দেখা যায়, টিনশেডের ছোট্ট একটি বাড়িতে ছোট দুটি কক্ষ। বারান্দায় বসে ভ্যান নিয়ে বের হওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন কালু। বাড়ির সামনে ছোট্ট উঠানে দাড়ানো ভ্যানটি। দুই হাতের ওপর ভর করেই চলছে সব কাজ। কালুর সাজ-গোছ শেষে নিজেই দুই হাতের সাহায্যে ভ্যানে উঠছেন। ব্যাটারিচালিত ভ্যানটিতে সবকিছু স্বাভাবিক দেখা গেলেও চালক বসার সিটটা দেখতে একটু আলাদা। বসার আসনটি চেয়ারের আদলে তৈরি করেছেন তিনি। এরপর বউয়ের সাহায্য নিয়ে উচু রাস্তায় উঠে চলে যান জীবিকার সন্ধানে।

জানা যায়, পাঁচ ভাই বোনের মধ্যে কালু বিশ্বাস সবার বড়। হাঁটা চলা করতে না পারার কারণে সার দিন বাড়িতেই থাকতে হতো তাকে। সংসারে অভাব থাকায় কোনো উপায় না পেয়ে ১৫-১৬ বছর বয়স থেকে ঝিনাইদহ আদালতচত্বরে ভিক্ষা করতেন। সমাজসেবা থেকে তাকে একটা হুইল চেয়ার দেয়। সেই হুইল চেয়ারে করেই তিনি বাড়ি থেকে শহরে যেতেন ভিক্ষা করতে। বাবা-মা বৃদ্ধ, দুই ভাই বিয়ে করে পৃথক হয়ে যায়। তাকে দেখার মতো আর কেউ থাকে না। ২০০৩ সালে জেলার শৈলকুপা উপজেলার হাবিবপুর গ্রামের আজিজ শেখের মেয়ে রিজিয়া খাতুনের সঙ্গে বিবাহ হয়। তার স্ত্রীও কিছুটা মানসিক ভারসাম্যহীন। তবুও তাদের সংসারে দুই ছেলে মেয়ে। বড় ছেলের বয়স ১৯ বছর। ছোট মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার দুই বছর হলো। 

এভাবে দীর্ঘদিন ভিক্ষাবৃত্তি করে জীবিকা নির্বাহ করলেও এটা তার মনকে সায় দিচ্ছিল না। আর তাই তিনি ভিক্ষাবৃত্তি ছেড়ে নিজে কিছু একটা করার চিন্তা করেন। এজন্য দুই বছর হলো তিনি ভিক্ষা ছেড়ে ব্যাটারিচালিত ভ্যান চালানো শুরু করেন। এখন ভ্যানটির ব্যাটারির শক্তি কমে এসেছে। আগের মতো বেশিক্ষণ ভ্যান চালাতে পারেন না। চারটি ব্যটারি নতুন লাগাতে হবে। একদিকে সংসারের বোঝা অন্যদিকে নতুন ব্যটারি কিনতে হবে। এই নিয়েই দুশ্চিন্তায় আছেন কালু। তবুও তিনি মানসিকভাবে শান্তিতে আছেন, নিজে পরিশ্রম করে উপার্জন করেন। করতে হয় না ভিক্ষা। 

প্রতিবেশী হাসিনা বেগম জানান, দীর্ঘদিন ধরে হুইল চেয়ারে করে কালু ভিক্ষা করতো। দুই বছর হলো ভ্যান চালায়। দুই ছেলে মেয়ের মধ্যে মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। ছেলে বিভিন্ন কাজ করে বেড়ায়। তার সংসারের অভাব কাটেনি। জীবনে অনেক কষ্ট নিয়েই বড় হয়েছেন তিনি। বিয়ে করেছে বউটাও মানসিকভাবে অসুস্থ।

প্রতিবন্ধী কালু বিশ্বাস বলেন, ‘সাড়ে চার বছর বয়স থেকে পোলিও রোগে আক্রান্ত। অভাবের সংসারে বড় ছেলে হয়ে বাড়িতে বসে থাকতে পারিনি। যার কারণে ভিক্ষাবৃত্তিকে বেছে নেই। ভিক্ষা করেই ভাই বোনদের খাইয়ে বড় করেছি, বোনদের বিয়ে দিয়েছি। ছোট ভাই বোনেরা বড় হয়ে আলাদা হয়ে গেছে। আমাকে আর কেউ দেখেনি। ২৫ বছর ধরে ভিক্ষা করে সবার জন্য অনেক কিছু করেছি। কিন্তু বিনিময়ে কিছুই পাইনি।’

‘মানুষের কাছে ভিক্ষার জন্য দয়া অনুগ্রহ নিয়ে চলা খুবই কষ্টের। মনে মনে অনেক কষ্ট হতো, রাতে নামাজ পড়তাম এবং আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করতাম এই বলে যে, আল্লাহ্ তুমি আমাকে আর কতকাল ভিক্ষার থালা হাতে মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরাবা। তবে এই সমাজের লোকজন, সরকারের কাছে আমার আবেদন তারা যদি আমার সুন্দরভাবে চলার জন্য পাশে দাঁড়াতো বা কিছু সাহায্য করতো, যাতে আমাকে আর কোনোদিন মানুষের দোয়ারে যেতে না হয়। আমিও চাই সুস্থ মানুষের মতো কাজ-কর্ম করতে।’

কালু বিশ্বাস বলেন, ‘রাসুল (সা.) ভিক্ষাবৃত্তিকে নিরুৎসাহিত করেছেন। আগে আমি হাজার টাকা ভিক্ষা করে সংসারে খরচ করেছি কিন্তু কোনো তৃপ্তি পাইনি। এখন ভ্যান চালিয়ে যা আয় হয় তা দিয়ে পরিবার চালাই। এতে মনে একধরনের প্রশান্তি কাজ করে। আমার ইচ্ছা আমি আর কখনো ভিক্ষা করব না।’ 

৫নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য ওয়াসিম মন্ডল বলেন, ‘আমাদের ওয়ার্ডের কালু বিশ্বাস খুবই অসহায় মানুষ। আগে ভিক্ষা করতো। বর্তমানে প্রতিবন্ধী হয়েও ভ্যান চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে। তিনি অন্যের ওপর বোঝা নয়, নিজে উপার্জন করে বেঁচে থাকতে চায়। অন্যের ওপর নির্ভরশীল না হয়ে ভ্যান চালাচ্ছে। অনেক আগে থেকেই কালুর প্রতিবন্ধী ভাতার কার্ড আছে। আমরা পরিষদে যাবার পর টিসিবির পণ্য ক্রয়ের জন্য পরিষদ থেকে একটা কার্ড করে দিয়েছি। তার সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি, তাকে যদি একটি ইজিবাইক দেয়া যায় তাহলে হয়তো তিনি আরও ভালো জীবনযাপন করতে পারবেন।’